Wellcome To AlorPoth's Official Website

১১৩.দৃষ্টিভঙ্গি


লেখক :সত্যজিৎ রায়
আমরা সংগ্রহ করেছি :প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোডকৃত "ফেলুদা সমগ্র" এ্যপ থেকে
cell1_3cell2_3
cell1_4cell2_4

নীল কামিজ আর ধবধবে সাদা সালোয়ার, সাথে সাদা ওড়না বুকে পিঠে পেচিয়ে স্কুলে যায় মিতালি। এবার অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে ও। গায়ের রং ধবধবে সাদা না হলেও মেয়েটার চেহারার মধ্যে অনেকটা মায়া আছে। ঘন পাপড়িওয়ালা চোখ দুটো মেলে যখন কোনো দিকে তাকিয়ে থাকে ও, তখন ওকে একদমই বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ লাগে। ওর চাহনি দেখে আর কেউ ওর মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারে না।
ছোটবেলা থেকেই মিতালি সাদামাটা থাকতেই পছন্দ করে। শ্যামবর্ণ মেয়েরা একটু সাজগোছ করলে যে তাদের পরীর মতো সুন্দর লাগে এই কথাটা মিতালি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। ও ভাবে, শ্যামবর্ণ মেয়েরা সাজলে পেত্নীর মতো অসুন্দর লাগে। তাই ও একদমই সাজে না কখনো। কেবল প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় দুচোখ ভরে কাজল পরতে ভালোবাসে ও। ও ভাবে, চোখের কাজলে থাকে ভালোবাসা। যা একদিন ওর স্বপ্নের রাজকুমার কে এনে দেবে। কিন্তু ও এটা ভাবে না যে, ওর চোখের ওই কালো কাজলে থাকে অনেকের লোলুপ দৃষ্টি।
মিতালি স্কুলে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করে, পথিমধ্যে অনেকেই আড় চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ও সাদা ওড়নাটা আরেকটু টেনে আঁটোসাটো করে গায়ে পেচিয়ে মাথা নিচু করে স্কুলে যায়। স্কুলেও কয়েকজনের আড় চোখের শিকার হয় ও। ক্লাসে বসে বেঞ্চের উপর দুহাত মেলে তার উপর মাথা নেতিয়ে দিয়ে ভাবে, আজ যদি আমার কোনো ভাই থাকতো, তাহলে সবার কুনজরের কথা ভাইকে বলতাম। এখন কাকে বলব আমি ওদের কুদৃষ্টির কথা? আমার হয়ে কে ওদের বারন করবে বা ভয় দেখাবে আমার দিকে কুদৃষ্টি না দেওয়ার জন্য? এসব ভেবে খানিকটা কেঁদে চোখ মোছে মিতালি।
স্কুল থেকে ফেরার পথে আবার ওইসব মানুষদের দেখতে পায় মিতালি। ও আবারো ওড়নাটা আঁটোসাটো করে গায়ে দিতে দিতে দেখে, কেউ কেউ ওর দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসে। এ হাসির অর্থ কোনো ভালোবাসা প্রকাশ পাওয়া নয়, এ হাসির অর্থ আমি জ্যন্ত মানুষখেকো। এ হাসি দেখে অনেকটা ভয় পায় মিতালি। ও তাড়াতাড়ি করে হেঁটে বাড়ি চলে যায়।
মিতালির মা কয়েকটি বাড়িতে কাজ করে একদমই সময় পায় না মিতালিকে দেওয়ার জন্য। সারাদিন কাজ করে রাতে বাড়ি ফেরে সে। রাতে সে যখন রান্নাঘরে রান্না করতে ব্যস্ত, তখন মিতালি কয়েকটি বই খুলে সামনে নিয়ে ভাবে, আজ আমার বাবা বেঁচে থাকলে ওই মানুষখেকো মানুষগুলো ওমন কুদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে সাহস পেত না। এসব ভেবে কাঁদে ও। তাদের লোলুপ দৃষ্টি আর বাজে হাসিমাখা মুখ যখন মিতালির চোখের সামনে ভাসে, ওর বুকের মধ্যে হাহা করে ওঠে কিছু হাহাকার। চোখের পানি মুছতে মুছতে ও ভাবে, এসব নোংরা কথা মাকে বলব। আবার দুচোখ বেয়ে টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পানি গরিয়ে ভাবে, এসব শুনে যদি মা আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়? দোটানায় পড়ে মাকে আর কিছু বলে না মিতালি।
..
মিতালির দিকে লোলুপ দৃষ্টি প্রদান কৃত মানুষের অভাব না থাকলেও তাদের মধ্যে মিতালি সব থেকে বেশি ভয় পায় পাশের বাড়ির রিমন কে। রিমনের শকুনের মতো দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মিতালি ভেজা বিড়ালের মতো চুপসে যায়। তার যথাযথ কারণও আছে। গেল বৈশাখ মাসে একবার দুপুর থেকে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। তাই দেখে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। বৃষ্টিতে ভিজতে বড্ড ভালো লাগে মেয়েটার। ও অনেকটা আনন্দ নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ কোথা থেকে রিমন এসে মিতালির হাত ধরে বলল, " চল, আজ আমরা একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ করি। " কথাটার মধ্যে কেমন বিশ্রী এক গন্ধের আভাস পেল মিতালি। সে রিমনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে বাড়ি চলে যেতে বসল। রিমনও এক খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে মিতালির পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলো। ভাগ্যবশত, সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার জন্য কিছু ছেলে-মেয়ে পথে ভিড় জমিয়েছিল। আর তাদের ভিড় ভেদ করে রিমন মিতালির কাছ অব্দি পৌঁছাতে পারে নি। তারপর একদিন দুপুরে ঝড় উঠেছিল খুব। সেই ঝড়ের মধ্যে মিতালি ওর লাল ঝুটিওয়ালা মোরগটা খুঁজতে খুঁজতে রিমনদের বাড়ির পাশে চলে গিয়েছিল। সেদিন ঝড়ের মধ্যে রিমন মিতালির হাত ধরে টানতে টানতে জোর করে ওর রুমে নিয়ে গিয়েছিল। মিতালি সেদিন ভয়ে আকাশ পাতাল চিৎকার করে উঠেছিল। ওই সময়েই রিমনের মা ঝড়ের কবলে পড়া রিমনের কাপড়গুলো উঠানের তারের উপর থেকে রিমনের রুমে রাখতে এসে মিতালিকে দেখে ফেলে আর অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে মিতালির মুখে কোষে এক থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সেই থেকে মিতালি রিমনকে একদমই দেখতে পারে না। তবুও রিমন যেন মিতালির পিছ ছাড়তেই চায় না। ওর দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মিতালি বুঝতে পারে, একটু সুযোগ পেলেই মানুষখেকো রিমনের খাবার হবে ও। তাই রিমনকে দেখলেই দৌড়ে পালায় মিতালি।
একদিন বিকালে কাজ ফেলে বাড়ি চলে আসে মিতালির মা। মিতালি তার গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। মায়ের এই অবস্থা দেখে মিতালি অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ে। ও কী করবে তা বুঝে উঠতে পারে না। ওর মায়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে খারাপতর হতে থাকে। মিতালি দেখলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর মায়ের জন্য ঔষধ আনতে হবে। মাকে ঘরে রেখে দু'মাইল দূরে ডাক্তারের দোকানে ছুটে যায় মিতালি। ওই দোকানে যেতে মিতালির ভয়ই করছিল। কারণ, অনেকদিন আগে একবার মিতালি খুব অসুস্থ হওয়ায় ওর মা ওই ডাক্তার কে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। চিকিৎসা শেষে যখন ডাক্তার চিকিৎসার আর ঔষধের দাম চেয়ে বসে, তখন নিজের কাছে টাকা না থাকায় কারো থেকে ধার করে কিছু টাকা আনতে যায় মিতালির মা। সেদিন অসুস্থ এই মিতালির সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দে ওই নরপশু ডাক্তার৷ অসুস্থ মিতালি সেদিন কোনো প্রতিবাদ করতে না পারলেও বুঝতে পারে এই হাত বুলানোর মানেটা জঘন্য। আর সেই ডাক্তারের সামনে যেতে ওর দ্বিধাবোধ হলেও মায়ের জন্য যেতে বাধ্য হচ্ছে ও।
সেবার অনেকদিন স্কুলে না যাওয়ার কারণে মিতালি জানতো না যে স্কুলে ছুটি চলছে। সেদিন স্কুল বন্ধ দেখে খুশি হয়ে মিতালি ভাবলো, অনেকদিন পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ির পরিত্যক্ত পুকুরঘাটে যাওয়া হয় না, পরিত্যক্ত হলেও ওই পুকুরের পানিতে এক অসাধারণ জাদু আছে। ওই পুকুরঘাটে বসলে কিছু সময়ের জন্য মনটা খুব ভালো হয়ে যায়। আজ ওখানে গিয়ে একটু পুকুরের পানির সাথে গল্প করে আসি।" এসব ভেবে পুকুরঘাটে গেল মিতালি। পুকুরঘাটে পৌঁছে মিতালি দেখল, সেখানে কয়েকজন জাল টেনে মাছ ধরছে। মন খারাপ করে ও বাড়ি ফিরতে যাবে, তখন কেউ ওর নাম ধরে ডাকায় ঘুরে দাঁড়াল ও। তখন একজন জাল টানা ফেলে মিতালির কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওই মানুষখেকো মানুষদের মতো হাসতে লাগল। সেই হাসি দেখে মিতালির মনের আকাশ অন্ধকার হয়ে এলো। ও বুঝতে পারল, সমাজের ওই
সব মানুষখেকো মানুষদের মতো এরাও আমাকে খেতে চাইছে। ভাবতে ভাবতেই সে মিতালির হাত শক্ত করে ধরে অট্টহাসিতে পতিত হলো। মিতালি এক মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেলেও পর মুহূর্তে তার হাতের উপর কামড় দিয়ে দৌড়ে চলে এলো জনবহুল পথটায়। পথে এসে মিতালি দ্রুত পায়ে হাঁটে আর ভাবে,,, " কেন মেয়েরা আজ পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টিতে পড়ে? কেন আজ আমাদের কোনো সম্মান নেই? কেন কেউ আমাদের দিকে সম্মানের দৃষ্টিতে তাকায় না? আর কতকাল সমাজ এভাবে নোংরা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতে থাকবে? কবে আমরা সম্মানের সাথে স্বাধীনভাবে চলতে পারব?"
জানি এসব প্রশ্নের কোনো জবাব মিতালি পাবে না। তবুও ও এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে..............!!
Share This

0 Response to " "

Post a Comment

Online Counter